সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ বছর করার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। এ বিষয়ে তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছেন। জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীদের পক্ষে একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি এই সুপারিশ করেছেন। সিদ্ধান্ত কী হবে, সেটি নেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষিত চাকরিপ্রার্থীরা প্রায় ১০ বছর ধরে সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩০ বছর থেকে বৃদ্ধি করে ৩৫ বছরে উন্নীতকরণের দাবি জানিয়ে আন্দোলন করে আসছেন। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীরা দফায় দফায় অরাজনৈতিক ও অহিংস কর্মসূচি পালন করে এলেও এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে এসব কর্মসূচিতে মাঝে মাঝে পুলিশ লাঠিপেটা করে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে। সরকার বা প্রশাসন কেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে না নিয়ে দমনের পথ বেছে নিচ্ছে? সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩০ বছর থেকে বৃদ্ধি করে ৩৫-এ উন্নীতকরণের দাবি কি একেবারেই অযৌক্তিক?
বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা আজ থেকে ৩২ বছর আগে ১৯৯১ সালে ২৭ বছর থেকে ৩০ বছরে উন্নীত করা হয়, যখন বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৫৭ বছর। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে ৭৩ বছর হলেও চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা হয়নি। ২০১১ সালে সরকারি চাকরি হতে অবসরের বয়স ২ বছর বৃদ্ধি করে ৫৭ থেকে ৫৯ বছর করা হলেও চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা কিন্তু বৃদ্ধি করা হয়নি। অন্যদিকে সরকারি চাকরিজীবীদের চাকরি শেষে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ স্বাভাবিক চাকরি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে আরেক অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কোভিড-১৯ মহামারির সময় প্রায় সব ধরনের চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা বন্ধ ছিল। এতে চাকরিপ্রত্যাশীদের জীবন থেকে প্রায় ৩টি বছর হারিয়ে যায়। পৃথিবীর অনেক দেশেই করোনা মহামারির ফলে সৃষ্ট ক্ষতি পুষিয়ে দিতে চাকরিতে প্রবেশের বয়স আরও ২-৩ বছর স্থায়ীভাবে বাড়ানো হলেও বাংলাদেশে শুধু ‘ব্যাক-ডেট’ দিয়ে আবেদনের সুযোগ দেওয়া হয়, যা কিনা ছিল পুরোপুরি বৈষম্যমূলক ও অপরিকল্পিত।
একই দেশের নাগরিক হয়েও আমাদের শিক্ষার্থীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) আবেদনের বয়সসীমা ৩০ বছর হলেও সরকারি নার্সিং এ ৩৫ বছর এবং বেসরকারি স্কুল/কলেজে ৩৫ বছর।
দুঃখজনক হলেও সত্য, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান/সংস্থাগুলোও চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা সরকারি মানদণ্ড অনুযায়ী ৩০ বছরকেই অনুসরণ করে আসছে, যা চাকরি প্রত্যাশীদের আরেক বিপাকে ফেলেছে। কেননা অনার্স-মাস্টার্স শেষ করতেই গড়ে একজন শিক্ষার্থীর ২৫/২৬ বছর বয়স হয়ে যায়। সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ৩–৪ বছর সময়ের মধ্যে চাকরি পেতে ব্যর্থ হলে পরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাগুলোর চাকরিতে প্রবেশেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় এই বয়সসীমা।
চাকরিতে প্রবেশের বয়স নিয়ে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিশ্বের ১৬২টি দেশে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ বছর, কোনো কোনো দেশে আবার তা উন্মুক্ত। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বিভিন্ন রাজ্যভেদে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫-৪৫ বছর, মালদ্বীপে ৪৫ বছর, শ্রীলঙ্কায় ৩৫ বছর, নেপালে ৩৫ বছর এবং আফগানিস্তানে ৩৫ বছর। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শুধু বাংলাদেশ ও পাকিস্তানেই চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩০ বছর।
আক্ষেপের বিষয় হলো বাংলাদেশের জাতীয় যুব নীতিতে ১৮-৩৫ বছর বয়সীদের যুবক বলা হলেও ৩০ বছর বয়সেই তাঁদের চাকরিতে আবেদনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না।
বর্তমানে লাখো বেকার চাকরিপ্রত্যাশীদের প্রাণের দাবি, তাঁরা সরকারের কাছে চাকরি বা কোনো প্রণোদনা চান না। তাঁরা চান অনতিবিলম্বে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর থেকে বৃদ্ধি করে ৩৫ বছরে উন্নীত করা হোক, প্রয়োজনে চাকরি হতে অবসরের বয়সসীমাও বৃদ্ধি করা হোক।
বর্তমানে সাধারণত সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর। তবে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ক্ষেত্রে তা ৩২।
চাকরিপ্রার্থী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ দীর্ঘদিন ধরে চাকরিতে আবেদনের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। তাঁরা বিভিন্ন সময় বলে আসছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ থেকে ৫৯ বছর পর্যন্ত। অর্থাৎ বয়স নয়, যোগ্যতাই একজন প্রার্থীর একমাত্র মাপকাঠি। ওই দেশের আলোকে বাংলাদেশেও চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ বছর করা দাবি করে আসছেন। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ওই সব শিক্ষার্থী দফায় দফায় কর্মসূচি পালন করে এলেও এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। এখন শিক্ষামন্ত্রীও একই ধরনের সুপারিশ করলেন।